আমরা কি অনলাইনে যাব নাকি যাব না এটা এখন অনেক শিক্ষকদের কাছে একটা ডিবেট এর টপিক। কেউ বলছেন করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচি আগে তারপর পড়াশুনা। কেউ বলছেন অনেকে গ্রামে আছে তাদের খাওয়ার টাকা নেই, ইন্টারনেট কিনার টাকা নেই, ডিভাইস নেই, স্মার্ট মোবাইল নেই, বিদ্যুৎ নেই এমন আরো নানা সমস্যা।
আমি সব গুলোর সাথে একমত। আসলেই করনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। এটা এসে দুনিয়ার তাবৎ বড়ো বড়ো দেশ, কোম্পানিকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। চারদিকে মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সকল ফেস টু ফেস ক্লাস বিগত ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ। কতদিন চলবে কেউ জানেনা।
আমরা যদি আমাদের মৌলিক চাহিদার কথা ধরি তাহলে শিক্ষার অবস্থান কিন্তু চিকিৎসার পরেই। কাজেই এটা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। চলমান ডিবেটে অংশ নিতে চাই। আমি গত ৩ মাস ধরেই এটার পসিটিভ, নেগেটিভ দিক নিয়ে কথা বলছি। ই-লারনিং প্লাটফরম নিয়ে কথা বলছি। কাজ করছি তো সেই ৪ বছর ধরেই। আমি জুম ব্যবহার করি সেই ৪ বছর ধরে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে অবস্থানের সময় থেকে। দেশে জুমের মাধ্যমে আমি প্রথম ক্লাস নিলাম মার্চের ১৬ তারিখ (বলতে পারেন দেশের উচ্চ বিদ্যাপীঠের প্রথম ক্লাস আমার জানা মতে)। আর গুগল ক্লাসরুম তো দেশে ব্যবহার করছি সেই গত বছরের এপ্রিল থেকে। কাজেই নিতান্ত আগ্রহ থেকেই এই সব শেখা এবং কাজে লাগানো। আমি শিখি সবসময়।
কাজেই আমার ব্যাক্তিগত নিতান্ত আগ্রহ থেকেই অনলাইনে যাবার ব্যাপারে কিছু লেখার প্রয়োজন মনে করছি। আমার মনে হয় আমরা কোন রকমের ডাটা কালেকসান ছাড়াই কিছু কথা বলছি যেটাকে সবাই অনলাইনে যাবার অন্তরায় বলে ভাবছেন।
- আচ্ছা ধরে নিচ্ছি ৪০% ছাত্র গ্রামে থাকে তাদের ইন্টারনেট নেই, স্মার্ট ফোন নেই।
- আসলেই কি আমরা জানি এই সংখ্যাটা কতো? যারা গ্রামে গেছে তাদের অনেক কেই সারা দিন অনলাইন দেখি কিন্তু।
- আমরা কি ডাটা কালেক্ট করেছি নাকি আন্দাজে বলছি?
- তাদেরকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া এই সিদ্ধান্তে আসছি কি করে?
যদি হয়েই থাকে তাহলে বাকি ৬০% যারা ক্লাস করতে পারবে তাদের বঞ্চিত করছি কেন? এরাই কিন্তু সংখ্যায় বেশি। আমরা এদেরকে নিয়ে শুরু করে দিয়ে যারা আমাদের সাথে যোগদান করতে পারছে না তাদেরকে বিকল্প ব্যবস্থায় সাথে নিয়ে আগাতে কি পারি না? কারণ যে কোন কাজেই সবাই প্রস্তুত থাকেনা কিন্তু শুরু না করলে সেটা নিয়ে আগানো যাবে না বলে আমার বিশ্বাস। যেমন যুদ্ধ ক্ষেত্রে কোন সহযোদ্ধা গুলি খেলে কিন্তু বাকি সবাই সেখানে বসে কান্না কাটি করেনা। গুলি খাওয়া যোদ্ধাকে নিয়েই কিন্তু বাকিরা সামনে এগিয়ে যায়। এই মেথড ব্যবহার করেই আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি কিন্তু ।
৪০% কে সাহায্য করার জন্য অনেকেই এগিয়ে আসবে্ন। যেমন এলাম্নাই, বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই (যেমন আমরা ছাত্রদের থেকে ল্যাব ব্যাবহারের জন্য টাকা নেই যেটার আসলেই এখন দরকার নেই। সেই টাকা দিয়ে ইন্টারনেট কিনে দেয়া যায় এমন আরো কত কি?)। তবে যেহেতু অনেকে বলবেন অনেক বিভাগ এ ফেস টু ফেস ল্যাব ব্যাবহার করা লাগে (সায়েন্স বিভাগ) তারা হয়ত অনলাইন ক্লাস শুরু করতে পারবেন না কিন্তু আমাদের বিজনেস, কলা এবং আরও অনেক বিভাগ চাইলেই শুরু করতে পারে। এটা অনেকটা মোবাইলের আওতা বাড়ানোর মত হতে পারে আইমিন ফেইজ বাই ফেইজ। কিন্তু শুরু করে দেয়া উচিত। বাকিরা আস্তে আস্তে জয়েন করবে। কিছু না পাওয়ার থেকে কিছু পাওয়া উত্তম না?
কিভাবে? তাহলে শুনুন আমার কথা।
প্রাথমিক ভাবে অনলাইন ক্লাস করতে যা লাগবে-
সবচে আগে লাগবে ইচ্ছাশক্তি (শিক্ষক, ছাত্র সবার)।আমরা আসলেই চাই কিনা সেটায় সবার সহমত লাগবে।
তারপর-
১। স্মার্ট ফোন (যেটা গ্রামের অনেক ছাত্রদের ও আছে। ছাত্ররা অনেকেই টিউশানি করে এগুলা কিনে ফেলেছে)।
২। ল্যাপটপ (হয়ত বেশির ভাগের এই নেই)
৩। মোবাইল ডাটা
৪। বিদ্যুৎ সংযোগ
উন্নত দেশ একদিনে আজকের জায়গায় যায়নি। তাদের ২০-২৫ বছর লেগেছে। আমরাও শুরু করলে হয়ত ৫ বছরেই সেখানে যেতে পারব। জাতি হিসেবে আমরা কুইক লার্নার। গত দুই মাসেই যেই পরিমান মানুষ জুম, গুগুল মিট, ক্লাসরুম শিখেছে করনা না আসলে এ্টা শিখতে হয়ত ১০ বছর লাগত। এই কাজে একটা ইকো সিস্টেম লাগবে, সবার সাহায্য লাগবে।
এখানে কাজ করবে-
১। শিক্ষা মন্ত্রণালয় (সবার ছাতা হয়ে কাজ করবে)।
২। বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ/স্কুল/মাদ্রাসা/কারিগরী
৩। সরকারের আইসিটি বিভাগ
৪। মোবাইল কোম্পানি
৫। ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি (ব্যাঙ্ক)
আমরা একদিনেই অনলাইন কেন চাচ্ছি? আমরা শুরু না করলে তো এগুতেই পারবনা। একটা প্ল্যান দিচ্ছি, দেখুন।
১। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ঃ
২০২০ এ সরকারের বাজেট এ বরাদ্দ টাকা থাকবে (শিক্ষা কিন্তু মৌলিক অধিকার এবং অনেক টাকা বরাদ্দ থাকা উচিত) যেটা দিয়ে ফেইজ বাই ফেইজ কাজ আগাবে। সকল শিক্ষার লেভেল (বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ/স্কুল/মাদ্রাসা/কারিগরী) এর জন্য টাকা লাগবে। সেটা ব্যয় হবে পেডাগজি তৈরি, ট্রেনিং, টেকনোলজি প্রস্তুতের জন্য।
২। বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ/স্কুল/মাদ্রাসা
সবাই বরাদ্দ টাকা নিয়ে প্রস্তুতি নিবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের আইটি, কোর্স, ই লার্নিং ব্যাকবোন তৈরি করবে। টেকনোলজির ক্যাপাসিটি বাড়াবে। মুডল, মুক বানাবে। এখন আবার জিজ্ঞেস কইরেন না মুডল, মুক কি? গুগল করেন।
৩। আইসিটি
টেকনিকাল সাপোর্ট বিল্ডাপ করে দিবে। মুডল, মুক বানিয়ে দিবে। এয়ার, ভিয়ার, এয়াই এর সাপোর্ট দিবে।
৪। মোবাইল কোম্পানি
তারা যদি ১ টাকায় ৩০ জিবি ডাটা দিতে পারে (ডাক্তারদের) তাহলে ১০০ টাকায় ১০০ জিবি ডাটা ও দিতে পারবে। তাদের সিএসার ফান্ড থেকেই না হয় দিল। স্টুডেন্ট ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করল। ছাত্ররা তাদের ইউনিক আইডি দিয়ে ডাটা কিনল। এতে অপব্যাবহারের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি ইন্টারনেটের গতি বাড়াতে কাজ করবে দেশ ব্যাপী। এটা দরকার। ২০০৬ সালে সাবমারিন ক্যাবলে সংযুক্তির পর ১৪ বছরে যে গতি পেয়েছি সেটা পর্যাপ্ত না। দেশে এখন ইন্টারনেট সংযোগ সবার লাগছে। ফ্রিলেন্সাররা কাজ করছে। দ্রুত গতি দরকার। সরকারের চাপেই করবে। ডাটা প্যাক সস্তা করে দিতে হবে।
৫। ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি (ব্যাঙ্ক)
তারা স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ কিনার জন্য ইন্সটল্মেন্ট চালু করবে। যেটার জন্য ছাত্রদের শ্ব শ্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্যারানটর হবে। যারা ডিভাইস কিনল তারা ব্যাঙ্ক এর ফাইনাল ক্লিয়ারেন্স নিয়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের পাস এর সার্টিফিকেট নিলো। ছাত্ররা নিজেরাই টাকা দিবে কিস্তিতে ধীরে ধীরে। দেশের অনেক গুলা কলেজ, প্রাইভেট ভার্সিটি ছাত্রদের ভর্তির সময়েই ল্যাপটপ দেয় এবং প্রথমে কিছু টাকা নিয়ে নেয় (প্রথম বর্ষেই) বাকিটা ধিরে ধিরে ৪ বছর ধরে কেটে নেয়।
কাজেই চাইলেই অনেক বুদ্ধি বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।
অনলাইনে চলে গেলেই যে মুক্তি তাও কিন্তু না। ঝামেলা সামনে আসছে অন্য জায়গায়। বাইরের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ভয়ে আছে তারা না আয়ের অভাবে (ছাত্র হীন)দেউলিয়া হয়ে যায় (ইদানিং কার অনেক লেখা লেখি আছে, দেখতে পারেন, গুগুল করতে পারেন)। তারা অনলাইনেও আছে অনেক দিন তারপর ও কিসের ভয়? উন্নত বিশ্ব এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো ছাত্র হারাচ্ছে নানা কারনে। হয়ত এতো টাকা খরচ করে পড়ে চাকরির অনিশ্চয়তা একটা গ্রুপ কে সংশয়ে ফেলে দিচ্ছে। তাদের দেশে দেখলাম সবাই পলিটেকনিকে পড়ে বেশি এবং ২০ বছরের আগেই কাজে লেগে যায়।
গত পরশু দেখলাম অস্ট্রেলিয়াতে “প্রায় ২২,০০০ শিক্ষক, স্টাফ বেকার হবে” আগামী ১ বছরে এমন একটা প্রেডিক্সান দিল। ছাত্র না পেলে বেতন দিবে কিভাবে? ছাত্র কিন্তু পাচ্ছে অনলাইন বেইজড প্লাটফরম গুলো যেমন Edx, Udemy, Coursera, Course Hero ইত্যাদি। কাজেই তাদের সাথে কম্পিটিসানে টিকতে গেলে যেটার দরকার সেটা পড়ানো উচিত আমাদের। আমার তো মনে হয় আগামী ৫ বছরে দুনিয়ার ৩০% বিশ্ববিদ্যালয় দেউলিয়া হয়ে যাবে। কেন সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?কাজেই বিশ্ববিদ্দালয় গুলি এখন কার যে সব টাইপের ডিগ্রি দিচ্ছে সেগুলাতে আর ছাত্ররা সামনে আগ্রহী হবে বলে মনে হয়না। বিবিএ, এমবিএ বা কগ্নিটিভ স্কিল বেইজড ডিগ্রি আর কতো? এই সব ডিগ্রি নিয়েও বেকারত্ব কমানো যাচ্ছেনা। গত জানুয়ারি মাসে আমাদের দেশে দেখলাম ৭৬ লাখ শিক্ষিত বেকার। যেহেতু কম্পানিগুলা অনেক কে রিডান্ডেন্ড করছে কাজেই নতুন রিক্রুট্মেন্ট ও করবেনা সামনে। করোনার পর এটা হবে হয়ত ১.৫ কোটি।
কাজেই স্কিল বেসড শিক্ষা দেন। পলিটেকনিক গুলাকে প্রমোট করুন। এত এত শিক্ষিত মানুষ এর দরকার কি? আমি মজা করে বলি আমাদের দেশে যত বিবিএ, এম বি এ আছে অনেক দেশে এত মানুষ ও নেই। কাজেই ছাত্রদের কে নন কগ্নিটিভ স্কিল শিখান। সফট স্কিল শিখান। এটাই ছাত্রদেরকে আয়ের পথ করে দিবে। আগে যেমন সবাই চিন্তা করত দেশেই চাকরি করবে। এখন স্কিল থাকলে গ্লোবালি কাজ করার সুযোগ আছে। সবাইকে চাকরি মুখি না করে বেশি করে উদক্ত্যা বানান। এই দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ যাদের বয়স ৩০ এর নিচে (যতদূর জানি)। আইটি স্কিল থাকলে এই খাত গার্মেন্টস, প্রবাসী আয় কেও ছারিয়ে যাবে। ১৯৯১ সালে সাবমেরিন ক্যাবল না নিয়ে এমনিই বিশাল ভুল হয়েছে। ১৫ বছর পরে জয়েন করেছি ঠিকি কিন্তু প্রায় ১০০ বছর পিছিয়ে গেছি আমরা। পাঁশের দেশ ভারত দেখেন আজকে দুনিয়া লিড দিচ্ছে এই খাতে। গুগল, মাইক্রোসফট থেকে অনেক বিগ জায়ান্টের সিইও ভারতের। কাজেই এখুনি সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকারি সময়।
আজকে আমরা চিন্তা করছি অনলাইন যাব কি যাবনা। কয়েকদিন পর দেখবেন প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নামবেন।
লিখেছেন ——-
ডঃ রাফিউদ্দীন আহমেদ
ই লার্নিং বিশেষজ্ঞ এবং সহযোগী অধ্যাপক
মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: rafi.mkt@du.ac.bd